থানা হেফাজতে ‘বিষপানে’ নারীর মৃত্যু, তিন পুলিশ বরখাস্ত
‘স্বামীর’ পুরুষাঙ্গ কেটে দেওয়ার অভিযোগে তাকে হেফাজতে নিয়েছিল ভাটারা থানা পুলিশ।
নিজস্ব প্রতিবেদক, দৈনিক বাংলাদেশ অনুসন্ধান।
ঢাকার ভাটারা থানা হেফাজতে থাকা অবস্থায় ‘বিষপান করে’ মারা গেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এক নারী, যাকে ‘স্বামীর’ পুরুষাঙ্গ কেটে দেওয়ার অভিযোগে হেফাজতে নিয়েছিল পুলিশ।
ফিরোজা আশরাভী নামের ওই নারী ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির গ্লোবাল স্টাডিজ অ্যান্ড গভর্নেন্স বিভাগের লেকচারার ছিলেন। আর আহত ইসমাঈল সুজন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সোশাল সায়েন্স অ্যান্ড হিউমিন্যানিটিজ বিভাগের লেকচারার।
পুলিশ জানিয়েছে, থানা হেফাজতে আনার পর ফিরোজা বলেছেন, সুজন তার স্বামী। কিন্তু সুজনের পরিবার বিষয়টি অস্বীকার করেছে।
এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি করেছে বলে ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে।
থানা হেফাজতে ফিরোজার মৃত্যুর ঘটনায় ‘দায়িত্বে অবহেলার’ অভিযোগে ঢাকার ভাটারা থানার তিন পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করার তথ্য দিয়েছেন বাড্ডা জোনের সহকারী কমিশনার এইচ এম শফিকুর রহমান।
বরখাস্ত হওয়া পুলিশ সদস্য হলেন- এসআই জামাল হোসেন, কনস্টেবল শারমিন ও নাছিমা।
ভাটারা থানার ওসি রাকিবুল হাসান বলে, ফিরোজার বাসা ঢাকার বসুন্ধরা এলাকায়। আর ইসমাঈলের বাসা পল্লবী এলাকায়। বুধবার রাত সাড়ে ৩টার দিকে ইসমাঈলের বাসায় ঘটনাটি ঘটে।
“ঘুমন্ত অবস্থায় স্বামীর পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলেন ফিরোজা। এরপর ফিরোজা নিজেই তাকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করান। তার স্বামীর পরিবারের লোকজন হাসপাতালে আসার পর বিকেলের দিকে ফিরোজার সঙ্গে তাদের বাগবিতণ্ডা শুরু হয়।
ওসি বলেন, বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টার দিকে ফিরোজা নিজে ৯৯৯ এ ফোন করে জানান, তাকে আটকে রাখা হয়েছে।
“এ খবর পেয়ে ভাটারা থানার একটি দল গিয়ে এভারকেয়ার হাসপাতাল থেকে ফিরোজাকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসে। তাকে থানায় আনার পর পল্লবী থানা থেকে জানানো হয়, স্বামীর পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলার ঘটনায় তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।”
ঘটনার বিস্তারিত শুনে ভাটারার পুলিশ ওই নারীকে থানায় এনে পল্লবী থানা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে। পল্লবী তখন ফিরোজাকে আপাতত ভাটারাতেই রাখতে বলে।
পুলিশ বলছে, থানা হেফাজতে থাকা অবস্থায় ফিরোজা বিষপান করেন। শুক্রবার সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
ফিরোজাকে হাসপাতাল থেকে ভাটারা থানা হেফাজতে নিয়ে আসা এসআই মো. আরিফ বলেন, “আমরা এভারকেয়ার হাসপাতালে গিয়ে দেখি দুই পক্ষের মধ্যে তর্কাতর্কি চলছে। সুজনের আত্মীয়রা তখন বলতে থাকে তাকে যেন আমরা না ছাড়ি। এরপর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশনায় ফিরোজাকে থানায় এনে ডিউটি অফিসারের পাশে নারী পুলিশের পাহারায় রাখা হয়।”
ফিরোজা থানায় বসেই আইনি সহায়তার জন্য আইনজীবীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরে ‘লিগ্যাল এইডে’র কর্মী পরিচয় দেওয়া দুজন ট্রান্সজেন্ডার থানায় আসেন। ফিরোজা তাকে বসুন্ধরার বাসার চাবি দিয়ে মোবাইলের চার্জার ও ইনহেলার নিয়ে আসতে বলেন।
কিছুক্ষণ পর ওই ট্রান্সজেন্ডার বাসা থেকে চার্জার ও ইনহেলারসহ একটি প্যাকেটে একটি বোতল নিয়ে আসে। এসব হাতে পেয়ে ফিরোজা বোতল মুখে দিয়ে পান করতে থাকলে পাশে থাকা নারী কনস্টেবল বাধা দেন। ফিরোজার সঙ্গে ধস্তাধস্তিও হয়।
গন্ধ ‘সুবিধাজনক’ মনে না হওয়ায় পরে বোতলটির গায়ে কীটনাশক লেখা দেখা যায়। তাকে তখনই কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে ‘ওয়াশ করা’ হয়। পরে সেখান থেকে রাত ১০টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার সন্ধ্যায় ফিরোজা মারা যান বলে জানান এসআই আরিফ।
পুলিশ কর্মকর্তা শফিকুর রহমান বলেন, পুরুষাঙ্গ কর্তনের ঘটনায় পল্লবী থানায় মামলা হওয়ায় চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় ফিরোজাকে পল্লবী থানার হেফাজতে হস্তান্তর করা হয়। আর আত্মহত্যার চেষ্টার ঘটনায় ভাটারা থানায় আরেকটি মামলা হয়েছে।
ওই মামলায় ট্রান্সজেন্ডার শোভা ও কণাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
পুলিশ বলছে, ফিরোজা কুরিয়ারের মাধ্যমে ওই বিষের বোতল কিনেছিলেন। কুরিয়ারের কাগজপত্রও ইতোমধ্যে পুলিশ সংগ্রহ করেছে।
পল্লবী থানার ওসি নজরুল ইসলাম বলেন, “ভিকটিম সুজন এখন এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। পল্লবী থানার মামলায় অভিযুক্ত ফিরোজা বিষপানে মারা যাওয়ার আগে বলেছিলেন, সুজনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে। তবে সুজনের পরিবার তা স্বীকার করেনি। পুলিশ বিষয়গুলো খতিয়ে দেখছে।”
Leave a Reply